জিয়াউর রহমান চরিত্রটি বাংলাদেশের ইতিহাস আর রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের জন্য একটি দারুণ আগ্রহের বিষয় হতে পারে। জিয়াউর রহমান শুধু ইতিহাসের বর্ণময় চরিত্রই নন বাংলাদেশের রাজনীতির ক্রিটিক্যাল রাজনৈতিক কিছু সময় জিয়ার হাত ধরে কেটেছে। ফলে তিনি যেমন ইতিহাস নির্মাণ করেছেন, তেমনি ইতিহাসও এক জিয়াউর রহমানকে নির্মান করেছে।
জিয়ার নির্মোহ মুল্যায়ন বাংলাদেশের রাজনীতির গতি প্রকৃতি ও ভবিষ্যৎ নিশানা বুঝতে পারার জন্য জরুরী। প্রথম মুল্যায়ন হতে পারে জিয়া এবং বিএনপির হিস্টরিক নেসেসিটি; এবং দ্বিতীয় মূল্যায়ন হতে পারে জিয়া এজ এ পলিটিক্যাল ক্যারেক্টার এন্ড মিলিটারি অফিসার। এই পর্যালোচনায় আমি ইচ্ছে করেই বিএনপি সমর্থক কারো মূল্যায়নের স্কেল ব্যবহার করছিনা। যেই আলাপগুলো তুলবো, তা বিএনপি ঘরানার বাইরের মানুষদের লেখা দিয়ে সাবস্টেন্স্যিয়েট করতে পারবো।
বিএনপি এবং জিয়ার উত্থান অবশ্যম্ভাবী ছিল সেদিক থেকে কথাটা তুলব না। বরং এভাবে বলব আমাদের যা যা যতটুকু হতে পারার সম্ভাবনা ছিল আমাদের দুর্বলতা সবলতাসহ, ঝগড়া-বিবাদসহ এরই এক প্রকাশ হল যেন জিয়াউর রহমান।
অনেকে বলতে চেষ্টা করেন, জিয়া ভাগ্যবান ছিলেন এবং রাইট টাইমে রাইট জায়গায় থাকার কারণে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন। কথাটা হয়তো সর্বাংশে মিথ্যা নয়। কিন্তু ওই যে বললাম কোন কার্যকারণ ছাড়াই রাজনৈতিক ঘটনাগুলো ঘটেছিল এমন ভাবার কোন কারণ নাই। এই কার্য কারণের অন্তত একটা কারণ হল জিয়ার ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্ব। সেই আলাপটা আজকের জন্য তোলা থাক। আসুন আমরা প্রথম ইস্যুটা নিয়ে কিছু আলাপ করি।
জিয়ার ক্ষমতায় উত্থান কোন আকস্মিক ঘটনা মনে হলেও তা নয়। স্বাধীনতা –উত্তর বাংলাদেশ বহু রাজনৈতিক অস্থিরতা পারি দিয়ে শেষে একটু স্থিতিশীলতা চাইছিল যেটা ঘটনাক্রমে বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে আর আসে নাই। ঘটনার জটিলতার তাঁর দুঃখজনক মৃত্যু হয়। কিন্তু তাতে মানুষের সেই আকাঙ্খা থমকে দাড়ালেও হারিয়ে যায় নাই। সে আকাঙ্খা পূরণের নেতাই হয়ে উঠেছিলেন জিয়া। জিয়া সেই রাজনৈতিক নেতা হয়ে উঠেন যিনি আর ব্যর্থতা নয়, বরং বাংলাদেশের মানুষকে সফলতার কিছু আলোর দিকে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। এবং অবশ্যই যিনি পুর্ববঙ্গের পলিটিক্যাল এসপিরেশনকে ধারণ করতে পেরেছিলেন। পুর্ববঙ্গের মানুষের মৌলিক পলিটিক্যাল এসপিরেশন কি ছিল?
কলোনি যুগ থেকে বললে, পুর্ববঙ্গের এসপিরেশন ছিল জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ। যার মধ্যে দিয়ে এই পুর্ববঙ্গে একটা ক্যাপিটালিজম গড়ে উঠবে। কাজ সৃষ্টি হবে। এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস আছে এই জমিদারি প্রথার উচ্ছেদের বিরুদ্ধে। হাজী শরীয়তুল্লাহর নেতৃত্ব থেকে শুরু হয়ে সে লড়াইয়ে অসংখ্য কৃষক বিদ্রোহ হয়েছে পুর্ববঙ্গে। এই লড়াই করতে করতেই একটা পর্যায়ে মুসলিম লীগের জন্ম। এমনকি তাঁরা একটা আলাদা রাষ্ট্রও বানিয়ে ফেলল। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হল, কিন্তু ক্যাপিটালিজম আসলো কী? এলোনা। পুর্ব পাকিস্তানের উদ্বৃত্ত চলে যেতে থাকলো পশ্চিম পাকিস্তানে। আমরা শুকায়ে মরতে লাগলাম। আমরা প্রশ্ন তুললাম “সোনার বাংলা শ্মশান কেন?”। অনেকে খামোখা সাফাই যোগান বিপুল কৃষি-উদ্বৃত্বের পুর্ব-পাকিস্তান থেকে কিছু শিল্পের পশ্চিম পাকিস্তানে তো সে উদ্বৃত্ব পাচার হবেই। না এটা স্বভাবিক নয় কোন মতেই। কেউই নিজের উদ্বৃত্ব পাচার হতে দিয়ে কাজ সৃষ্ট ক্যাপিটালিজমের ভিত গাড়তে পারে না। বরং মুক্তিযুদ্ধ হল এই আকাঙ্ক্ষা থেকেই আমরা আর শোষিত হবোনা, আমাদের নিজের দায়িত্ব আমরা নিজেরাই নেব। ঐতিহাসিক ছয় দফাকে যদি দেখেন তাহলে সেইটার এসপিরেশন ছিল এই ভুখন্ডের সম্পদ দিয়েই একটা ক্যাপিটালিজম গড়ে তোলার আকাঙ্খ্যা।
বাংলাদেশ স্বাধীন হল। কিন্তু কাজ হল উলটা, কারখানা, ভারী শিল্প, ব্যাংক, বীমা সব জাতিয়করন হল, জমির উর্ধসিমা বেধে দেয়া হল। অথচ ক্যাপিটালিজমের মৌলিক অলিগলি না-বুঝ ফেলে রাখা হল, পুঁজিবাদ বিকাশের সব সম্ভাবনা। বিদেশী বিনিয়োগের পথ রুদ্ধ করা হল। ক্যাপিটালিজম আর হলনা। বিনিয়োগ ছাড়া কোন কাজ সৃষ্টি করে এমন ক্যাপিটালিজম কেমনে হবে? বিশ্বব্যাংকের ভাল-মন্দ কিছু না বুঝে তাকে তাড়িয়ে দেয়া হল।
বাংলাদেশে ক্যাপিটালিজমের অফিসিয়াল যাত্রা শুরু হয় জিয়ার হাতে। বিশেষ করে সেটা ছিল ইতোমধ্যেই গ্লোবালাইজেশনের পথে যখন দুনিয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়ে ফেলেছিল। বিশ্বব্যাংক পুর্ণ তৎপরতায় আসে জিয়ার আমলে, সরকার ক্ষুদ্র এবং ছোট-বড় ব্যক্তি মালিকানায় বিনিয়োগ খুলে শ্বাস নিবার মত উৎসাহিত করলো, জমির উর্ধ সিমা বাতিল হল, বাংলাদেশ থেকে প্রথম ব্যাপকহারে মানবসম্পদ রপ্তানী হওয়া শুরু হল, যা এখনো আমাদের রেমিটেন্সের প্রধান উৎস। ১৯৭৮ এ দশ হাজার পিস শার্ট রপ্তানী হয়ে আমাদের গার্মেন্টস শিল্পের গোড়াপত্তন হল।
বাংলাদেশের প্রথম মুক্তবাজার অর্থনীতির জন্য মার্কেট রিফর্ম হল জিয়াউর রহমানের হাতে।
ক্যাপিটালিজমের সাথে সাযুজ্যপুর্ন লিবারেল ভ্যালুজও আসার কথা, তা এসেছেও। রক গান, পশ্চিমা ধারণা, লাইফস্টাইল। বিটিভিতে আমরা প্রথম পশ্চিমা সংগীতের সাথে পরিচিত হলাম সলিড গোল্ড অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। কিন্তু একে জেনেবুঝে ঝাড়াই বাছাই করার নিজের হিম্মত তৈরি করার দিন সামনে। সেই পুর্ববঙ্গের কৃষকের এসপিরেশন প্রথম কিছু পুর্ণ রূপ পেয়েছিল জিয়ার হাতে। স্বাপ্নালু বাম চিন্তার রাজনীতি বাদ দিয়ে তিনি প্রথম দল করলেন বিএনপি যা এতোদিন ধরে এই ভুখণ্ডে চলে আসা রাজনীতির ফিউডাল উত্তরাধিকার থেকে মুক্ত হবারও প্রথম চেষ্টা বলা যেতে পারে। এইটাই ছিল জিয়া আর বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির হিস্টরিক নেসেসিটি।
জিয়াউর রহমানের শসসনকালের কিছু সমালোচনা নিশ্চয়ই হাজির করা যায়, সেটা করাটা জরুরীও। কিন্তু তাকে নিছক খাটো করার জন্য তার ঐতিহাসিক গুরুত্বকে অস্বীকার করাটা ইতিহাসের সাথে প্রতারণার নামান্তর।
জিয়াউর রহমানের সকল সমালোচনা সত্ত্বেও, তিনি আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণের নায়ক হয়েই চিরকাল বিরাজ করবেন।
লেখকঃ-
মোঃ সাব্বির , da.sabbir@hotmail.co.uk